নোয়াখালীর স্বর্গীয় সুরেশ্চন্দ্র ঘোষ তার স্বনামের চেয়ে "জুইন্যা ঘোষ" ডাক নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। প্রভাব ও প্রতাপ তার কোনটাই কম ছিল না। সেই জুইন্যা ঘোষের আজ কয়েকমাস দেহে দুর্বলতার আর একটা বিষন্নতার ছাপ মুখে-চোখে কেমন যেন নেমে এসেছে।কারণ, তার এক নিকট আত্মীয়া উন্মাদরোগগ্রস্তা।গ্রামে চিকিৎসার অসুবিধে বিবেচনা করে জুইন্যাবাবু তাকে তার নোয়াখালীর বাড়িতে এনে রেখেছেন যাতে ঐ রোগিণী আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে শীঘ্র রোগ-মুক্ত হতে পারেন।কিন্তু কয়েকমাস কেটে গেল, উপশমের বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখা গেল না বরং উত্তরোত্তর রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে লাগল। — feeling happy in Kolkata.
আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই মাঝে মাঝে তার বাড়িতে এসে অযাচিতভাবে তাকে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন, হয় কলকাতায় না হয় রাঁচীতে রোগিণীকে পাঠান হোক। এই রোগিণীকে এই মফঃস্বল শহরে রেখে রোগের উপশমের কথা ভাবা আকাশ-কুসুমেরই সমতুল। জুইন্যাবাবু তাদের কথা স্থির হয়ে শোনেন কিন্তু কোনও উত্তর দেন না।
ঘুরে ফিরে বারে বারে একটা কথাই শুধু তার মাথায় ঘুরছে।বছর দু'আড়াই আগে তার দৌহিত্রী শিশুটি সহসা মারাত্মক ডিপথিরিয়া রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ল, ক্রমশঃ কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল। সংবাদ পেয়ে তার শ্বশুরমহাশয় এবং শ্বশ্রূমাতা এসে পড়লেন, এলেন তার জামাতা এবং আরও অনেক নিকট আত্মীয়রা। অবস্থা ক্রমশঃই অতি দ্রুত মন্দের দিকে যাচ্ছিল। তার কন্যা শিশুটির শয্যায় বসে কাঁদছেন। তার সহধর্মিণী কাঁদছেন মেঝেয় বসে, এদিক ওদিকের ঘরে আরও অনেক আত্মীয়রা ক্রন্দন-রত। অস্থির ভাবে জুইন্যাঘোষ পায়চারি করছিলেন উঠানে। সহসা ঝড়ের বেগে তিনি ঘরে ঢুকলেন, বুকে করে নিলেন দৌহিত্রীকে এবং রূদ্ধশ্বাসে ছুটলেন তাকে নিয়ে পথে।উপেক্ষা করলেন সকলের নিষেধ, দৃকপাত করলেন না আপন ক্রন্দনরতা কন্যার দিকে। উপস্থিত হলেন গিয়ে শ্রীরামঠাকুর মহাশয় তখন যে বাড়িতে ছিলেন সেখানে। ঠাকুরমহাশয় তখন খাটের উপর বসে ছিলেন--সামনে ছিলেন দু'চারজন।জুইন্যাঘোষ ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করলেন। বক্ষলগ্না দৌহিত্রীটিকে ঠাকুরের পাদস্পর্শ করাইলেন।আর সামলে রাখতে পারলেন না নিজেকে জুইন্যা ঘোষের মত শক্তিশালী পুরুষও।কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, দৌহিত্রীটির রোগের কথা। ঠাকুরমহাশয় শিশুটির গলায় সস্নেহে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, "এই মা বড় হইয়া স্বামীর সঙ্গে কত ঝগড়া করবেন, সংসার সামলানোর জন্য,ঝি-চাকরকে কত গালি-গালাজ করবেন,ওর কি গলার স্বর বন্ধ হইয়া গেলে চলব!" বলতে বলতে ঠাকুরমহাশয় জুইন্যাবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, "এই রুগণা মায়েরে এই ঠান্ডার মধ্যে কেন নিয়া আসছেন।আলোয়ান জড়াইয়া এখনই নিয়া যান বাড়িতে।"
কী করে উপশম হবে তার কোন বিধান ঠাকুরমহাশয় দিলেন না। সত্যসত্যই এই রোগ সারবে কিনা সে কথাও ঠাকুর একবার উচ্চারণ করলেন না। বাড়িতে তিনি সকলের নিষেধ উপেক্ষা করে বড় আশা নিয়ে এখানে এসেছিলেন। এখন গিয়ে তাদের আশ্বস্ত করার মত কিছু পেলেন না। দুঃশ্চিন্তা তার আরও ঘনীভূত হলো।বাড়ির কাছাকাছি এগুতেই তিনি দেখলেন সব আত্মীয়-স্বজনরাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে,তার মেয়ে ছুটে গিয়ে জুইন্যাবাবুর বক্ষ থেকে আপন কন্যাটিকে কোলে তুলে নিলেন। মায়ের কোলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিশুটি স্বাভাবিক "মা"-"মা"-"ও মা" বলে ডাক দিল।সকলের মুখ-চোখেই আশার আলো জ্বলে উঠল।বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটি পূর্বের মত কলকন্ঠে আবার কথার ঝড় তুলে দিল। আনন্দের তুফান নেমে এল সারা বাড়ি জুড়ে। জুইন্যা ঘোষ শুধু ভাবছেন, রামঠাকুরের স্পর্শ--এতো ব্যর্থ হতে পারে না--তাতেই তার দৌহিত্রী রোগমুক্ত।
সম্ভাব্য সকল স্থানেই জুইন্যা ঘোষ পত্র দিয়েছেন ঠাকুরমহাশয় এখন কোথায় আছেন জানবার জন্য। উত্তর কারও কারও কাছ থেকে ইতিমধ্যে পেয়েছেন যে ঠাকুর ঐ স্থানে নেই,কোথায় আছেন জানতে পারলে তাকে জানাবেন। সেজন্য জুইন্যা ঘোষ অপেক্ষা করছেন-কতকাল আর অপেক্ষা করবেন রোগিণীর এই অবস্থায়? তিনিও ভাল করেই জানতেন যে,ঠাকুরমহাশয়ের নির্দিষ্ট নিবাস কোথাও ছিল না।স্বল্পকালের স্থিতি তাঁর ছিল এখানে-ওখানে-সেখানে।এই পরিস্থিতিতে অসহনীয় অবস্থা হলেও অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
রাত্রিতে রোগের বৃদ্ধি হয়।উন্মাদ রোগগ্রস্তদেরও ব্যতিক্রম নেই।সেই জন্যই কিছুকাল ধরে রোগিণীকে বাড়ির পিছনে একটা আলাদা ঘরে রাখা হয়েছে। সারাদিন একজন পরিচারিকা থাকে তার ঘরে।সে রোগিণীকে স্নান করায়,আহার করায়, পরিচর্যা করে।উন্মাদ রোগগ্রস্তাকে নিয়ে যে ধকল সামলাতে হয় সারাদিন তাতে নৈশবিশ্রাম তার নিতান্ত প্রয়োজন।রাত্রে আহারের পরে সে তার নিজের বাড়িতে যায় আবার সকালে ফিরে আসে।সারারাত ধরে পাগলিনীর ঘরে একটি প্রজ্জ্বলিত অবস্থায় দ্বিজ-লন্ঠন উপরে টাঙানো থাকে।বাইরে থেকে দরজায় থাকে দু'টি তালা দেওয়া।
স্তব্ধ-অর্ধরাতে সহসা জুইন্যাবাবুর ঘুম ভেঙে গেল একটি করুণ কাতর কন্ঠস্বরে।তিনি কান পেতে রইলেন,এতো প্রতিদিনের শোনা উন্মাদিনী ভৈরবীর তান্ডব ঝঙ্কার নয়। কিন্তু কাতর কণ্ঠস্বর ঐ ঘর থেকেই যেন ভেসে আসছে। উঠে পড়লেন জুইন্যাবাবু,পাশের ঘর থেকে ডেকে তুললেন তার সহধর্মিণীকে।লন্ঠন জ্বালিয়ে উঠলেন গিয়ে পাগলিনীর ঘরের বারান্দায়।জানালা দিয়ে দু'জনে দেখেই আতঙ্কে শিউরে উঠলেন--দু'হাত দিয়ে বধূমাতার রুধির ঝরছে, রুধির ঝরছে দুই ঠোঁট বেয়ে।রুধিরের চাপ রয়েছে বধূমাতার মুখ-মন্ডলে,এখানে সেখানে।এগিয়ে গিয়ে জুইন্যাবাবুর সহধর্মিণী জিজ্ঞাসা করলেন, "এ সর্বনাশ কে করলো? কে তোমাকে কামড়ে দিয়েছে?" বন্ধ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে জুইন্যাবাবু শুনছেন,বধূমাতা বলছেন-আমার দরজাটা খুলে দিন,আমি ঠাকুর ঘরে গিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করব।জুইন্যা ঘোষ চোখের ইঙ্গিতে এ প্রস্তাবে সম্মত হতে তার সহধর্মিণীকে নিষেধ করলেন। বধূমাতা আবার বলছেন, "ঠাকুরমহাশয় এসেছিলেন,আমাকে নাম দিয়ে গিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে--আমি ভাল হয়ে গিয়েছি আমাকে দরজা খুলে দিন--আমি ঠাকুরকে প্রণাম করব।"
সহধর্মিণীর অনুরোধ জুইন্যাবাবু একবার জানালার পাশে দাঁড়াতেই ত্রস্তহস্তে বধূমাতা বহুকাল ধরে অবগুন্ঠনে আনন আবৃত করেছিলেন।এ পাশে সরে এসে জুইন্যাবাবুর সহধর্মিণী ফিস ফিস করে জানালেন, ওর চোখ দু'টিতে স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে এসেছে,দেখছো না তোমাকে দেখে ওর লজ্জা ফিরে এসেছে।মনে হচ্ছে ও ভাল হয়ে এসেছে। দরজাটা খুলে দাও,ও গিয়ে ঠাকুর প্রণাম করুক। সম্মত হতে পারলেন না জুইন্যা ঘোষ। খবর পাঠালেন ডাক্তারকে। ডাক্তার অত রাত্রিতে আর এলেন না--পাঠালেন কম্পাউন্ডারকে।তিনি এসে প্রাথমিক চিকিৎসা করে ব্যান্ডেজ বেঁধে চলে গেলেন। বাড়ির অন্য সকলে ঐ জানালার সামনে গিয়ে ভিড় করল।বধূমাতা সকলের সঙ্গে একটি আধটু কথাবার্তা বলছিলেন।শুধু জুইন্যা ঘোষ ভোরের অপেক্ষায় একাকী উঠানে পায়চারি করতে লাগলেন।
পরের দিন সকালে জুইন্যা ঘোষের প্রথম কাজ হলো কয়েকজন অনুচরকে ডাকা। তারা এলে জুইন্যাবাবু বললেন নোয়াখালীতে যে সব বাড়িতে ঠাকুরমহাশয় আসেন তার প্রতিটি বাড়িতে তারা যেন খবর নেন যে ঠাকুরমহাশয় কি কাল কোনও বাড়িতে এসেছেন। বিশেষ করে নির্দেশ দিলেন সব বাড়িতে খোঁজ নিতে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে আর কয়েকজনকে পাঠালেন পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে--গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে খবর নেওয়ার জন্য,ঠাকুরমহাশয় এসেছেন কিনা এবং এলে কোন বাড়িতে এসেছেন।একটু বেলায় স্নান সেরে জুইন্যাবাবু ঠাকুরঘরে এলেন। সহধর্মিণী নৈবেদ্য সাজিয়েছেন।
পূজার উপকরণও প্রস্তুত। শুধু আসন পাতা বাকী। উন্মাদিনী বধূটি স্নান সেরে সিক্ত বসনে হস্ত প্রসারিত করে যে শুয়েছেন আর ওঠেননি। দ্বারে দাঁড়িয়ে জুইন্যা ঘোষ। তার সহধর্মিণী বধূটির কানের কাছে এসে বলছেন,তুমি একটু উঠো বৌমা,তোমার শ্বশুর তো পূজোয় বসতে পারছেন না,তুমি এখান থেকে না সরলে।বার কয়েক বলার পরে বধূমাতা একটু ওঠে বসলেন অদূরে। এই অবসরে জুইন্যাবাবুর সহধর্মিণী আসন পেতে দিলেন। জুইন্যাবাবু এসে সে আসনে বসে পূজো আরম্ভ করলেন। আর যাবার সময় জুইন্যাবাবুর সহধর্মিণী বধূমাতার কানের কাছে ফিস ফিস করে বললেন, বৌমা ভিজে কাপড়টা যে গায়েই শুকলো আবার একটা অসুখ বিসুখ না করে-ঘরে যাও,কাপড়টা পাল্টিয়ে এসো। সে কথায় যে বধূমাতা কোনও কর্ণপাত করেছেন তা ঝা গেল না, কারণ বধূমাতা সে ভাবেই বসে রইলেন।
বেলা তখন সাড়ে দশটা।জুইন্যা ঘোষ পূজো শেষে প্রসাদ দিচ্ছিলেন বারান্দায় বসে। এমন সময় অনুচরদের কয়েকজন ফিরে এলো।জুইন্যা বাবু তাদের প্রসাদ দিলেন। তারা জানালেন নোয়াখালী শহরে ঠাকুরমহাশয় কোনও বাড়িতেই আসেননি।গ্রাম-গ্রামান্তরেও যারা গিয়েছিল তারাও এসে জানালো,ঠাকুরমহাশয়ের উপস্থিতির সংবাদ তারা সংগ্রহ করতে পারেনি।জুইন্যাবাবু হতাশ হলেন, রোগিণীর আরোগ্য লাভ সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পরে দুইজন অনুচর দৌড়ে এসে জানালেন, মাইল কয়েক দূরে কোনও গ্রামে ঠাকুরমহাশয় আছেন দু'দিন ধরে। গৃহস্বামীর সঙ্গে অনুচরেরা দেখা করেই এই সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। গৃহস্বামীও জুইন্যা ঘোষের অপরিচিত নন।সুতরাং তিনি তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়লেন,দেরি করলে যদি ঠাকুরমহাশয়ের সঙ্গে দেখা না হয়।
বেলা প্রায় দু'টোর সময় জুইন্যাবাবু গিয়ে ঠাকুরমহাশয়কে প্রণাম করলেন। ঠাকুরমহাশয় তখন একাকী ছোট্ট একখানা বিছানার উপর বসেছিলেন। ঠাকুরমহাশয় জিজ্ঞেস করলেন, "এত বেলায় আপনে আইছেন এত কষ্ট কইর্যা,কি ব্যাপার?" জুইন্যাবাবু তাঁর নিকট আত্মীয়ের ব্যাধির,গত রজনীর কথা এবং সেদিন সকাল পর্যন্ত তার অবস্থা সবই সবিস্তারে বলিলেন। ঠাকুরমহাশয় চুপ করে শুনছিলেন।জুইন্যাবাবু তখন ঠাকুরমহাশয়কে জিজ্ঞাসা করলেন তার বধূমাতা বলছেন যে তিনি নাকি কাল রাত্তিরে গিয়ে বধূমাতাকে ''নাম'' দিয়েছেন এবং তার রোগমুক্তি হয়েছে তা কি সত্য না পাগলের প্রলাপ মাত্র।যদি তিনি গিয়ে থাকেন তা হলে কে সঙ্গে ছিল,কেইবা তাঁর গ্রাম্য পথে চলার সময় এই গভীর নিশীথে আলো দেখিয়েছিল।এই খাল-বিলে-ভরা গ্রাম্য পথ কী করে তিনি অতিক্রম করেছিলেন।এমন আরও কত প্রশ্ন তিনি করেছিলেন ঠাকুরমহাশয়কে।
"না গিয়া উপায় কী জুইন্যাবাবু? মা তো ছিন্নমস্তা হইছেন--নিজের দাঁতে নিজের হাত-ঠোঁট কামড়াইছেন! এখন মায় আমার সম্পূর্ণ সুস্থ হইছেন আর ''নাম'' করতে আছেন।" ঠাকুরমহাশয়ের এই ক'টি কথায় জুইন্যা ঘোষের স্থির বিশ্বাস হল যে বধূমাতা সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ করেছেন। তার জন্য চিন্তার বিন্দুমাত্র কারণও আর অবশিষ্ট নেই। ঠাকুরমহাশয় আবার বললেন, "এখন বাড়ি ফিইর্যা যান।আপনে নিজে মায়েরে তার নিজের সংসারে রাইখ্যা আসেন গিয়া।মায় না থাকায় ওনার সংসারে অনেক অসুবিধা এদ্দিন হইছে।"
জয় রাম জয় গোবিন্দ
Reviewed by srisriramthakurfbpage
on
ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪
Rating:
কোন মন্তব্য নেই: