বেদবাণী প্রথম খণ্ড
(১) যাহা ভগবান করেন তাহার হাত ছাড়ান জীবের সাধ্য নাই।
(২) প্রারব্ধ সূত্রে যাহা যখন যার উপস্থিত করে তার তাহাই ভোগ হয়, ইহার জন্য অনুতাপ এবং প্রয়াস করিতে নাই।
(৩) সংসারের তরঙ্গে লক্ষ্য রাখিয়াই জীব বদ্ধ হয় তাহাতেই লাভ-লোকসান অনুভূতি হইয়া থাকে, ইহাতেই সুখ-দুঃখকর শান্তি অশান্তির তরঙ্গ চলিয়া থাকে। অতএব, ঐ দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া কেবল শূন্যভাবে অর্থাৎ আকাশের দিকে চিন্তাকে ধরিবার জন্য চেষ্টা করিতে করিতে পরম শান্তির উদয় হয়। ভালমন্দ যাহা হয় সেই সকল অতিথির ন্যায় মনে ধারণা করিতে চেষ্টা করিতে হয়।
(৪) ত্যাগং, সত্যং, শৌচ, দয়া পরস্পর উদয় হইতেই হয়, অতএব সর্ব্বদা ত্যাগকে আশ্রয় করিতে চেষ্টা করিতে হয়। সেই ত্যাগকে লাভ করিতে হইলেই ঈশ্বরকে, অর্থাৎ ঐশ্বর্য্যশালীর প্রয়োজন। ক্ষেম, স্থৈর্য্য, আরোগ্য, ঐশ্বর্য্য অতএব ক্ষেম অর্থাৎ সহিষ্ণুতা সহ্য করা; সকল বেগ সহ্য করিতে করিতে ক্ষেম হয়, পরেই স্থৈর্য্য (স্থির) হয়, স্থির হইলেই আরোগ্য হয় অর্থাৎ ব্যাধি বন্ধন থাকে না। পরেই কোন অভাব না থাকিলেই ঐশ্বর্য্য হয়, পরেই ত্যাগ হয়।
(৫) এ সংসারে কোন মাত্র সত্যের বন্ধনে থাকাই পরম তত্ত্ব, পরমপদ, ইহা বই জগতে কিছুই নাই। সংসার নিত্যানিত্যের তরঙ্গ, এই তরঙ্গ হইতে নিষ্কৃতির জন্য অভিমানের সত্ত্বাকে মার্জ্জনা করিতে হয়। “জীবে দয়া, নামে রুচি, বৈষ্ণব সেবন, ইহা বই কিছু নাই শুন সনাতন”। এই শব্দটি সকল জীবের পক্ষেই কণ্ঠহার। ঐহিক সুখ আর দুঃখ সকলই ক্ষণভঙ্গুর। ক্ষমাই দয়ার আধার, ত্যাগই সত্যের সার, পবিত্রতাই ধর্ম্ম। যাহাতে মনের কোন রকম অশান্তি, মলিনত্ব না হয় তদ্বিষয়ে সহিষ্ণুতা দ্বারা মার্জ্জনা করাই উচিত। ক্ষণিক সুখে মজিয়া থাকিলে পরে পরিণাম দুঃখই থাকে, পরিত্রাণের জন্য অবশিষ্ট সুখরূপ সত্যের লেশও থাকে না। ঐহিক সুখে মত্ত হইয়া কৃত ধর্ম্ম নষ্ট করিতে নাই।
(৬) সকল ভার দিয়া প্রারব্ধ চর্য্যায় ব্রতী থাকিলে গুরুই সকল বিষম বিপদ সম্পদ হইতে উদ্ধার করেন।
(৭) যথা সাধ্য ভগবৎ চিন্তা করিতে হয়। সকল ভার গুরুতে ন্যস্ত করিয়া উপস্থিত সংসারের প্রারব্ধ কর্ম্ম যাহা যাহা আছে সাধ্য অনুসারে করিয়া যাইতে হয়। কোন বিষয়ে অধিক হর্ষ বিষাদ করিতে নাই।
(৮) বোঝা এবং না বোঝা দুইই এক, কারণ উভয়েই ভ্রান্ত। এই দুইয়ের অভাবই শান্তি।
(৯) জগতের সকলেই ভুলিতে, ত্যাগ করিতে, দুর্নাম করিতে, অভাব করিতে, ব্যাভিচারী বন্ধনের সামগ্রী দিতে কৃতসঙ্কল্পভাবে অধ্যবসায় হইয়া চেষ্টায় চেষ্টিত আছে। কিন্তু যার যা স্বভাব অত্যন্ত বিকৃতিতে পড়িলেও উদার প্রকৃতিতে তাকে মলিন করে না।
(১০) বিনা ভাড়ায় পরের ঘরে বাস করিতে হইলে ঘরের বেগ সহ্য করিতে হইবেই। লোকের দেহই বন্ধন। এই দেহকেই বাসনাময় বলিয়া থাকে। এই দেহকে মুক্ত করিতে চেষ্টা যাহা করিতে হয় তাহা কেবল ভগবানের শরণ বই আর কিছুই নয়। সাধ্য সাধনে নিষ্কৃতি হয় না। অতএব সর্ব্বদাই বাসনা পূর্ণের চেষ্টা না করিয়া তাহাদের দৌরাত্ম্য যথাসম্ভব ভোগের ভোগ করিতে হয়। প্রারব্ধ বশতঃই লোকে ভোগ হইয়া থাকে। ভাগ্য অনুসারে সুস্থ অসুস্থ দায়ে দায়ী হইতে হয়। প্রারব্ধই তাহার কারণ। আরোগ্য ও আরোগ তাহা হইতেই হইয়া থাকে, নচেৎ জীবের শক্তি নাই।
(১১) ভগবৎ শক্তি দ্বারা ভগবৎ সেবার শক্তি পাওয়া যায়।
(১২) সংসার মায়াময় ভ্রান্তিসূচক। কাহারও কোন কর্ত্তৃত্ব এ জগতে নাই, স্ব স্ব ভাগ্যানুসারে স্ব স্ব ভোগে রত হয়।
(১৩) সত্যধর্ম্ম পরিচর্য্যাই পরমানন্দ উৎপাদন করিয়া থাকে।
(১৪) সত্যকে সেবা করিতে করিতে সতী হয়। পতিব্রতা হইলে কালের হাত হইতে সত্যকে উদ্ধার করা যায়।
(১৫) চিন্তায়, কার্য্যে, শ্বাসপ্রশ্বাসে স্থিরভাব অবলম্বন করিয়া পতিব্রতা বা ভগবন্নিষ্ট হইলে শুচি হয়।
(১৬) সর্ব্বদা স্বকৃত কর্ম্মানুসারে যত্নবান থাকিয়া নিত্য তৃপ্তিকর ভগবৎ সেবার শক্তি আহরণের প্রতিক্ষা করিতে হয়। অর্থাৎ সকল ভার ভগবানে দিয়া ভাগ্যানুযায়ী কর্ম্মক্ষেত্রের আয় অনুসারে ব্যয় করিয়া ধীর ধৈর্য্যশক্তির দ্বারা পরম পদ লাভ করিতে পারা যায়। পথের সহায় সর্ব্বশক্তিমান ভগবান নির্লিপ্ত শক্তি বিতরণ করিয়া থাকেন, তাহার সাহায্যে এ ভবসংসারের আবরণ কাটাইয়া নিষ্কৃতিলাভ করিতে পারা যায়।
(১৭) ভগবৎ চর্চ্চা প্রকৃতির বশে দোদুল্যমান থাকে বলিয়াই বাসনাজালে বদ্ধ করিয়া লয়। তাহাই জীবদ্দশায় কর্ত্তাভিমান দ্বারা ক্রিয়া কর্ম্মতে বদ্ধ করিয়া দেয়। এই ভ্রান্ত মায়া মুগ্ধ জীবদ্দশা মুক্ত লইতে একমাত্র ভগবানের আশ্রয় ভিন্ন অন্য কোন উপায় সৃষ্টি হয় না বলিয়াই ভগবৎ পদ শরণের উদ্বর্ত্তন করিতে হয়, তাহাই কৃপাসাপেক্ষ। অতএব সর্ব্বদা যাহা প্রারব্ধবশে কর্ষণাধি বর্ষণ শক্তির উপভোগ উৎপন্ন পাওয়া যায়, সকল অবস্থায়ই উদ্দেশ্য স্মরণ রাখার দিকে চেষ্টা করিতে হয়।
(১৮) সংসার শব্দটিই অভাবের স্মারক, যাহাতে মনের সুখ দুঃখ উদয় হয়। তাহাই সংসার।
(১৯) নির্ম্মল আকাশে সূর্য্য চন্দ্র নক্ষত্র অমাবস্যা দিন যাহা দেখা যায়, সেই আকাশকেই তাহারা যত্ন করিতেছে। তদ্ অনুগত হইয়া এই প্রকার বৃত্তিগুলিকে মনের সঙ্গে নির্ম্মল আকাশ চিন্তায় যত্ন করিতে হয়। এই নির্ম্মল আকাশকে যত ঘনিষ্ঠ করিয়া সেই আকাশের চন্দ্রাদির ন্যায় নিজ শরীরে অবস্থান করাইতে পারা যায় ততই সাধ্যসাধন পাওয়া যায়। কোন আশা ভরসার দিকে যত্ন করিতে নাই। লাভ লোকসান হউক না হউক যেমন করিয়া সংসারে প্রারব্ধ ভোগ হয় সে সমস্ত কেবল সহ্য করিয়া গেলে পরে সংসারের চেষ্টা সকল আপনিই চলিয়া যাইবে। ভগবৎ চক্র উদয় করিবে, কোন দরকার থাকিবে না। কামনা বাসনা সকলি প্রারব্ধের দণ্ড। সর্ব্বদা নির্ম্মল আকাশে চন্দ্রসূর্য্যাদির ন্যায় মনকে লাগাইয়া রাখিতে চেষ্টা করিতে হয়। ইহাতে যাহা হউক আর না হউক সে দিকে লক্ষ্য রাখিতে নাই।
(২০) শরীরের প্রারব্ধ ঋণ পরিশোধ যে পর্য্যন্ত না করা যায় সেই পর্য্যন্ত ভোগাদির প্রতি কোন হাত নাই। যখন যাহা উপস্থিত হইবে তাহা ভোগ করিতে হইবে।
(২১) কর্ম্মক্ষেত্রের উপস্থিত কর্ম্মসকল, প্রারব্ধে যাহা দেয় তাহাতে বিরক্ত সন্তোষ না হইয়া, কর্ম্ম করিয়া যাইতে হয়। পিছনে গুরু সর্ব্বদাই রক্ষা করিয়া উদ্ধার করিয়া লইবেন। জীব অবস্থায় জীবের কোন কর্ম্ম ইচ্ছার দ্বারা সাধিত হয় না। যাহা ইচ্ছার মতন কর্ম্ম করিয়া ফলভোগ করিতে দেখা যায় তাহাও প্রারব্ধের প্রদত্তই হইয়া থাকে। যদি তাহা না হইবে তবে কোন কোন কর্ম্ম ইচ্ছা করিয়া করিতে গিয়া শক্তি পাই না কেন? যখন যে অবস্থায় গুরু রাখেন সেই অবস্থায়ই তৃপ্ত হইতে চেষ্টা করিতে হয়। কোন চিন্তা নাই, গুরু সকল অভাব হইতে নিষ্কন্টকে উদ্ধার সাধন করিবেন এই গুরুর স্বভাব।
(২২) প্রারব্ধাদি ভোগ ক্ষেত্রে ভোগান্ত অবস্থায় কিছুই থাকে না; সকলি সম হয়। ভাগ্যক্রমেই সকল জোটে এই জ্ঞানে সকল বেগই সমভাবে কাটাইতে হয়।
(২৩) স্থির হইবার চেষ্টা করিতে সকল অবস্থায়ই অনুষ্ঠান করিতে চেষ্টা করিবে। এইরূপ করিতে করিতে নিত্য চরিত্র পবিত্রতা লাভ করিয়া আত্মার বিদিত হইতে পারে।
(২৪) সর্ব্বদাই সহিষ্ণুতার অনুগত থাকিতে চেষ্টা করিতে হয়।
(২৫) সংসার মায়াময় ভ্রান্তিজনক, যাহা কিছু বোধ করা যায় তাহা সকলি ইন্দ্রিয়জাল মাত্র। মনের দ্বারা যাহা লব্ধ হয় সকলই ইন্দ্রিয় ভোগ মাত্র। ইহার সঙ্গে বুদ্ধি জ্ঞান সতত অস্বাভাবিক ভাবে চলিতেছে বলিয়া যাহা মনেতে আশ্রয় পায় তাহা সকলই ভ্রম, অতএব মনের আহরিত বস্তুর জন্য পিপাসিত হইতে নাই। জগতে যাহা কিছু অনুভূতি হয় সকলই ইন্দ্রিয় জানিবেন, ইহাই কেবল সুখ দুঃখ ফল প্রসার করিয়া জীবদ্দশাকে চক্রের ন্যায় ভ্রমণ করাইয়া লয়। সর্ব্বদাই পতিব্রতাচারণ করিয়া গুরোপদ্দিষ্ট কর্ম্মের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকিতে চেষ্টা করিবে। লাভ লোকসান, সিদ্ধ অসিদ্ধ গতিতে উপেক্ষা করিয়া মাত্র উপদ্দিষ্ট আশ্রয় কর্ম্মে মজিয়া থাকিতে চেষ্টা করিবে। উদ্ধার গুরুপদেই করিবে। ভাল মন্দের প্রতীক্ষায় থাকিলে পতিব্রত ধর্ম্ম অভিচারী হইয়া সত্ত্বায় মলিনত্ব ঘটে।
(২৬) সংসার মায়াময় ভ্রান্তিজনক, শত ঐশ্বর্য্য লাভেও পরিতৃপ্ত হয় না। পতিব্রত ধর্ম্ম ত্যাগ করিয়া কর্ম্ম করিতে প্রমুখ হইলে অসতী আখ্যা জগতে প্রচার থাকে। যাই হউক ঐহিকের সুখ যাহা কর্ম্মের দ্বারা প্রাপ্ত হয় তাহা কেবল মরীচিকাবৎ, ইন্দ্রিয় ডগার আড়ালে পড়িলে তাহার কিছুই থাকে না। অগ্রে বিষমিব পরিণামে অমৃতোপম এই সুখ সাত্ত্বিক জানিবেন। অতএব সুখের বন্ধনে আশা রাখিয়া বিপন্নদশার গৌরব বাড়াইতে নাই।
(২৭) সংসার মায়াময় ভ্রান্তিমূলক, ক্ষণস্থায়ী সুখ দুঃখ এই সকলই গুণাবতারের প্রবঞ্চনা মাত্র। ক্ষণকাল অস্থায়ী সুখের প্রলোভনে পড়িয়া জীব নিত্য সুখময় নিত্যানন্দ চৈতন্যহারা হইয়া সংসার গারদে ঘুরিয়া বেড়ায়। বঞ্চনার প্রলোভনে পড়িয়া সৎ অসৎ বিচারে অক্ষম হইয়া যাহা তাহা করিয়া মুগ্ধ হয়। ইন্দ্রিয়াদি ব্যাপারে চিরকাল ঘুরিয়া বেড়ায়। এই ভাষাকেই পণ্ডিতগণ নরক সম্ভার বলিয়া থাকেন। এই নরক মুক্তির জন্য গুরু আশ্রিত হইয়া তদাশ্রমে চিরপোষিত হয়। এই গুরুকৃপায় সর্ব্বশক্তি ভক্তির আবরণে অনায়াসে শান্তির বাসভূমি লাভ করিয়া নিত্য স্বরূপ লাভ করিয়া নিত্য সেবার দাস হয়।
(২৮) জগতের স্থূল আবরণে কিছুরই নিত্যত্ব নাই। অনাবৃত বীরের মৃত্যু হয় না, জন্মও হয় না। ভ্রান্তিবশতঃ স্থুল প্রকৃতিতে কর্ত্তৃত্ব জ্ঞান থাকায় অভাবের বোধে জীবগণ সুখ দুঃখ ভোগ করে। দেহের সঙ্গে সম্বন্ধ বলিয়া সত্য ঘাতক বলিয়া থাকে, দেহীর সঙ্গে অবস্থান করিলে দেহ মুক্ত হয়। অতএব, দেহ বিয়োগে শোক তাপের কোনই কারণ দেখা যায় না।
(২৯) বৃথা কর্ত্তৃত্বাভিমান জাগরণ করিতে নাই।
(৩০) এই সংসার মায়ামুগ্ধ মায়ামৃগে আকৃষ্ট হইয়া বাসনা জাগিলে চঞ্চলতা ঘটে। তাঁহার শরণ মাত্রই ভ্রম শোধন হইতে পারে পুনরায় মায়াজালে বন্ধ হয় না।
(৩১) সংসার মায়াময়। বিকৃতি স্বভাবের তরঙ্গ সুখ দুঃখ অনুভূতির প্রশ্রয়; এই সকলই অভাব, ভ্রম বুদ্ধি মাত্র। অতএব পতি সেবাতে সর্ব্বদা বিবৃত থাকিতে চেষ্টা রাখিবেন। ফলাফলের দিকে লক্ষ্য রাখিবেন না। পতিসেবার জন্য স্বর্গ নরক কিম্বা গভীর কালচক্রের ভ্রমণই হউক, তাহাই মঙ্গল সূত জানিবেন।
(৩২) প্রারব্ধের ভোগ শেষ না হইলে কিছুই করিতে শক্তি হয় না। শরীরটি পরের বশে চলিয়া যাইতেছে, নিত্য সর্ব্বত্রেই পরাধীন গাত্র ইন্দ্রিয়াদির দ্বারা বিবর্ণ হইয়া ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া থাকে। এই শরীরের উপর আধিপত্য কি হইতে পারে? সর্ব্বত্র সমভাবে প্রারব্ধের আকর্ষিত সুখ দুঃখ ভোগ করিতেই হইবে।
(৩৩) সমবুদ্ধির দ্বারা দৈহিক গুণজাত প্রারব্ধ ভোগদণ্ড ক্ষয় করিতে হয়। ভোগ মোক্ষ হইলেই জীবন দশা প্রাকার মুক্ত হইয়া মানবত্ব চলিয়া যায়। ব্রজবাসী যোগে নিত্য সেবাধীকারীর শক্তির সাহায্যে নিত্যসেবার যোগ লাভ করিতে পারিবেন। যখন যে অবস্থায় যে যে বিষয় আধিপত্য করিয়া মন বুদ্ধিকে চঞ্চল করে তাহা ক্রমশঃ সহিষ্ণুতা শক্তির আবরণ করিয়া অভ্যাসবশে রাখিতে চেষ্টা করিবেন, বিফলতা থাকিবে না। মনের শান্তি সুখাদি যাহা যোগদান করেন সকলি অনিত্য, অস্থায়ী, ভ্রান্তিমাত্র জানিবেন। সর্ব্বদা কেবল পতিগত হইয়া তাহারই উন্মুখ পৃষ্ঠভঙ্গ বর্জ্জিত হওয়াই জীবের পরম ধর্ম্ম।
(৩৪) সংসার চক্র উদয় অস্ত গতিভাবে অনবরত ঘুরিতেছে। এই ভ্রম শোধন জন্য ভগবানের অর্থাৎ সহিষ্ণুতার পরিণাম শক্তি শরণ দ্বারা শ্রদ্ধার উদ্বর্দ্ধন করিয়া লইতে হয়। লাভ অলাভ পিপাসা মুক্ত করিতে চেষ্টা করিতে হয়। সংসার প্রার্থনার আবরণে কেবলমাত্র বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া থাকে। যজনাদি ক্রীড়ার চর্চ্চায় তাহার নিবৃত্তি হয় না। কেবলমাত্র এক পতিব্রত শক্তিপদ আশ্রয় লইয়া অঘাচনা ভাবে প্রতিক্ষা করিয়া যথাসাধ্য গুরোপদিষ্ট সত্য সাধনের জন্য স্থিতিবুদ্ধির আহরণ করিতে পুনঃ পুনঃ চেষ্টা করিতে করিতে নিশ্চয়াত্মিকা শক্তির বৃদ্ধি হইয়া কামনা বাসনা লুপ্ত হইয়া থাকে। তখন সকল অভাবই দূর হইয়া আনন্দ প্রকাশ হইয়া যায়।
(৩৫) প্রারব্ধ ভোগের জন্য কোনরূপে চঞ্চল কি ভয় করিতে নাই। ভাগ্যে যাহা যাহা ভাল মন্দের যোগ হয় তাহা ভোগ করিতে নিশ্চয়ভক্তি অবশিষ্ট ভোগমুক্ত করিয়া সর্ব্বদা আনন্দ বর্দ্ধন করিয়া পরম শান্তি অবিচ্ছেদ রসের তরঙ্গায়িত করিয়া লয়। অতএব সর্ব্বদা যখন যেমনই অবস্থার উদয় হউক না কেন সহিষ্ণুতার দ্বারা সর্ব্বদা সহ্য করিয়া লইবেন। সর্ব্বদাই ভগবৎ সেবার জন্য দৃঢ় আলিঙ্গন শক্তির বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করিবেন।
(৩৬) এই সংসারে আশ্রয় পাইলে মুক্তির অভাব থাকে না । যথাসাধ্য কৰ্ম্মে সাধ্য সাধন করিয়াই গুরু কৃপার দ্বীপন হইয়া থাকে। উপাদান ভেদে শরীর গঠিত অনুসারে স্বভাব পায়, তৎদ্বারা ক্রীড়া কৰ্ম্ম চলিয়া থাকে। ইহার নিবৃত্তির জন্যই আশ্রয় প্রয়োজন হইয়া থাকে। স্বভাব অনুসারে গুরোপদিষ্ট কার্য্য যথাসাধ্য করিবেন।
(৩৭) সংসার মায়াময়, কেবল কর্ত্তৃত্বাভিমানেই মুগ্ধ। অহংপ্রাণের বৃদ্ধিই মায়াচক্রে ভ্রমণশীলতা লাভ করে। সুখ দুঃখ যাহার যাহার ভাগ্যবশতঃই লাভ হয়। শুভ অশুভ উভয়ই কৈতব প্রধান যাহা হইতে কৃষ্ণভক্তি অন্তর্দ্ধান হইয়া থাকে। শুভ অশুভ কর্ম্মই কৃষ্ণ ভক্তির বাধক হয়। ইচ্ছা, অনিচ্ছা জীবের অধিকার নাই, গুণ চঞ্চলতার বিবর্ণ মাত্র, অবিদ্যা কারখানা। ইচ্ছাময় অর্থাৎ যখন কোন ইচ্ছাই থাকে না সেই অবস্থায় কামগন্ধ বিন্দুমাত্রও ব্রজধামে থাকিতে পারে না, ঐ সকল অহংকারের পরিকর ধরফড়ানি মাত্র।
(৩৮) নিজ শক্তি বলের অভাব জীবের স্বতঃসিদ্ধ। কর্ত্তা হইয়া যে কোন যজ্ঞ করিতে হয় তাহা শিবহীন জানিবেন। ভূতাদিদ্বারা যজ্ঞ ভ্রষ্ট করিয়া থাকে। অতএব পতিব্রত ধৰ্ম্ম পালনই জীবের স্বতঃসিদ্ধ কৰ্ত্তব্য।
(৩৯) পুরুষ অভিমানী যদি সত্য সঙ্গ না করে তবে প্রত্যবায়ী হইতে হয়। জগতে সাহস করিয়া নিত্যমুক্তির জন্য দশবিধ সংস্কার সম্পাদন করিতে হয়। অদৃষ্টকে ভোগে বঞ্চিত করিতে নাই।
(৪০) প্রাক্তন দণ্ড যথাযথানুসারে ভোগের অতিক্রম করা জীবের পক্ষে ক্ষমতা নাই।
(৪১) সংসার মায়াময়, সকলই ভ্রান্তিমূলক, কর্তৃত্বাভিমান দ্বারা জড়িত। পতিপ্রাণা ভক্তিরসে সকল অভাবই মুক্ত হয়।
(৪২) প্রারব্ধ বশে আটক পড়িয়া যাহা করিতে বাধ্য হইবে তাহাতেই মধ্যস্থ থাকিতে চেষ্টা রাখিয়া গুরুর আদেশকর্ম্ম পালনে যত্নশীল হইতে চেষ্টা করিবেন। এই প্রকার করিতে করিতে ভগবানের শক্তি পূর্ণরূপে অধিষ্ঠান হইয়া নিত্যসেবার অধিকারীভাবে দেহবৈগুণ্য পরিহারে সমর্থ হইতে পারিবেন। ভগবান সিদ্ধ অসিদ্ধ, ভাল মন্দ বিচারের অতীত, অতএব সর্ব্বদা গুরুপদ আশ্রয়ে সাধ্যানুসারে পরিচর্য্যা কার্য্যে নিত্যব্রতী থাকিবেন। অচিরেই ভগবান উদ্ধার পদ খোলাসা করিয়া লইবেন।
(৪৩) ভগবৎ সেবা সর্ব্বদা করিতে করিতে নিত্য শক্তির বিকাশ হইয়া থাকে। সকল ইচ্ছার বেগ সহ্য করিতে করিতে সকল অভাব যাইয়া পূর্ণ স্বভাবে পরিণত হয়। পরের দোষ দেখিতে নাই, আপন দোষগুলির অনুসন্ধান করিয়া সর্ব্বদা দোষগুলিকে পবিত্র করিতে হয়। পরের স্বার্থজ্ঞান মলিনের কারণ হইয়া থাকে । যাহা কিছু আবির্ভূত হয় সকলি প্রারব্ধ বৃত্তি মাত্র, কাহারো কোন দোষ নাই। যাহার নিকট যে যে ঋণ পরিশোধ করার যে ভাবে ব্যবস্থা প্রাক্তনে উপস্থিত করে সেই সেই ভাবেই তাহা গ্রহণ হইয়া থাকে ৷
(৪৪) সংসার মায়াময়, ভ্রান্তিসূচক, সুখ দুঃখ প্রকাশক। সৰ্ব্বদা প্রারব্ধ গতির বিরোধী না হইয়া তাহাদের সেবা পরিচর্য্যার বাধা না দিয়া, কেবল ভগবানের সেবা নিষ্ঠায় যত্নবান হইতে চেষ্টা করিবেন। বাসনাদি যাহা রজগুণের তরঙ্গ তাহারা সকলই উদয় হইয়া অস্ত হইবে। তাহাদের তাড়না জালের প্রতি লক্ষ্য না রাখিয়া আপন ইষ্ট সেবায় লক্ষ্য রাখিয়া যাইবেন। অচিরেই ভগবান এই মায়াক্ষেত্রের বিকার হইতে উদ্ধার করিয়া লইবেন সন্দেহ নাই। সাধ্যমতই ভগবানের সেবাচর্য্যা করিয়া যাইবেন। মনের চঞ্চলতার দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া কেবল সেবার আশ্রয়ে থাকিবেন। মনের ধর্ম্মই হইয়াছে চঞ্চল। সৰ্ব্বদা সেবাকার্য্যই ব্রজের পরিকর জানিবেন।
(৪৫) ব্রজবধূর কৃষ্ণভক্তি প্রেমের তরঙ্গে চঞ্চলই আকর্ষণ করিয়া থাকে এবং বিষ অমৃত একত্র হইয়া ভগবৎ সেবায় পূর্ণ শক্তিমান হয় বলিয়া শান্তির অভাব থাকিয়াই যায়। শান্তি হয় না। ইহাই ভগবানের প্রেমের লক্ষণ জানিবেন। যেখানে শান্তির তরঙ্গ উদয় আছে সেখানে সমতাভাব হয় মাত্র কিন্তু প্রেমের অভাব থাকিয়া যায়। অতএব ভগবৎভক্ত শান্তিময় অজস্র ঐশ্বর্য্যকে তুচ্ছ করিয়া থাকে। মায়ামুগ্ধ বুদ্ধি কেবল শান্তির তৃপ্তি খোঁজে। ব্রজের পথে ঐহিক প্রারব্ধের কন্টক চৌদিকেতে বিকশিত হয়। কালের ঋণ শোধন জন্যই পতিব্রত আচরণে যত্নশীল হইয়া সতীধর্ম্ম কায়ক্লেশে ভোগান্ত করিয়া নিত্যমুক্ত ভক্তির উর্ব্বান করিয়া পথ রাখিয়া গিয়াছেন।
(৪৬) সংসার মায়ামুগ্ধ ভ্রান্তিজনক। এই সংসারে প্রারব্ধভোগে পরিচালিত হইয়া থাকে। বাসনাকুলে বিব্রত হইয়া সত্য প্রতিষ্ঠার চঞ্চল হয়। কর্ম্মক্ষেত্রে সহিষ্ণুতাই সামর্থ্য প্রকৃতির উদ্বর্ত্তন করিয়া থাকে। প্রলোভনীয় পথে নানা উপসর্গ জুটিয়া চিত্তকে কলুষিত করিয়া লয়, তাহা হইতেই নানা উপায় অবলম্বন করিয়া জগতে অভাবগ্রস্থ হইয়া পড়ে। নানা পথে চালিত হইয়া, নানাগুণের তরঙ্গদ্বারা শান্তির অশান্তির সংঘটন করে। মুক্তি পাবে বলিয়া মায়া অর্থাৎ ভ্রান্তি যোগ আশ্রয় নিয়া যজ্ঞ ভুলিয়া যায়। যজ্ঞ শেষ করিতে পারে না। যজ্ঞ হারাইয়া নানাবিধ কাল দণ্ডের অধীন হইয়া গতাগতিময় পুনঃ পুনঃ জগতে নানারূপে সুখ দুঃখে লাঞ্ছিত হইতে দেখা যায়। স্থির বস্তুর সঙ্গ না পাইয়া, পতিসেবা হারাইয়া নানাবিধ উপায় সৃষ্টিদ্বারা কেহ সন্ন্যাসী, কেহ জাপক, কেহ যোগী, কেহ ভোগীরূপ ধারণ করিয়া আশু সুখ অনুভূতিদ্বারা সর্ব্বতোভাবে ব্যবসায়ী বুদ্ধির আবৃত হইয়া যায়। এই সকল কেবল মায়ামন্ত্র জানিবেন। সকল উদ্দেশ্যবিধান ছাড়িয়া একমাত্র পতিসেবায় নিত্য নিযুক্ত থাকিতে চেষ্টা করিবেন। বর্ত্তমানে পতিসেবাই পরম পুরুষার্থ, ইহা বই আর কিছুই নাই। ভগবৎভক্তিদেবী কোন অভাব প্রবর্ত্তন করান না, সর্ব্বদাই পবিত্র করিয়া দেন।
(৪৭) ভগবান ত্রিজগতে সর্ব্বদাই জাগরণ থাকেন, তাঁহার কোন অঙ্গই ত্রিজগৎ ছাড়িয়া থাকে না। কর্ত্তৃত্বাভিমান প্রকৃতির গুণজাত হইয়া অহঙ্কার দ্বারা তৎপদ লক্ষ্য করিতে পারে না বলিয়াই নানা আশু সুখদায়ক কর্ম্মফল অন্বেষণ করিয়া, হিতাহিত হারাইয়া কর্ত্তব্য ত্রুটিতে পড়ে। তজ্জন্যেই জগতের চর অচর পদে পড়িয়া যায়। অতএব, সর্ব্বদা তৎলক্ষ্য রাখিতে চেষ্টা করিবেন।
(৪৮) সংবৰ্দ্ধন কার্য্য কর্তৃত্বাভিমানীতে সাধ্যসাধনে প্রাপ্ত হয় না বলিয়াই পতিব্রতা ধৰ্ম্ম জগতে বহু নায়ক নায়িকা প্রবণ করিয়া কীর্ত্তিপথ স্থাপন করিয়া রাখিয়াছেন। অতএব পতিব্রত ধৰ্ম্ম ব্যতীত অন্য কোন ধৰ্ম্ম সহায়ে কৃতকাৰ্য্য সম্পাদন হইতে পারে না। মনের সুখ বোধ যাহা হয় তাহা কেবল প্রকৃতির বিকারমাত্র, ক্ষণস্থায়ী।
(৪৯) প্রারব্ধ সংসার না হওয়া পর্যন্ত চিত্তবিনোদ উদয় হয় না। পূর্ব্বাপর মহাশক্তির জীবনীতে সকলই প্রকাশ আছে, চিন্তা নাই।
(৫০) প্রাক্তন সূত্রে যে সকল ভাব মনাদি ইচ্ছার বশ্যতা স্বীকার হয় তাহাই ভ্রান্তি, সকলই মনের জল্পনা কল্পনা মাত্র । সকল অবস্থায় অবিচলে সহিষ্ণুতার দ্বারা ভোগ করিয়া যাইতে যাইতে প্রারন্ধমুক্ত হইয়া নির্ম্মল চৈতন্য লাভ করিয়া থাকে। পুনরায় আর ভ্রান্তিমুগ্ধ গারদ দণ্ডে বন্ধন হয় না।
(৫১) অকাতরে প্রারব্ধ বেগ সহ্য করিয়া সকল অভাব মুক্ত হইতে চেষ্টা করিবে।
(৫২) কৃষ্ণের পুত্রাদি যদু বংশকে তাহাদের প্রকৃতির ভোগের নিমিত্ত নিষেধ বিধান কৃষ্ণ হইতে হয় নাই। তাহাদের প্রবৃত্তির উৎসুকের কর্ম্ম সর্ব্বথাই করিয়াছিল। যথাসময়ে তাহারা মুক্তিলাভ করিয়াছিল। তাহার কারণ যদুবংশীয়গণ নিশ্চয় কৃষ্ণই কর্ত্তা জানিত। এইজন্য তাহাদের কর্ত্তৃত্বাভিমান ছিল না। ইহাই সাধন। আত্মাই দেহের কর্ত্তা, প্রারব্ধ ভোগই দেহের কর্ম্ম, এই জ্ঞানে অভিমানী হইয়া অতি দুরাচারীও নিত্যমুক্তি লাভ করিতে পারে। কর্ত্তৃত্বভাবে অহং বুদ্ধি দ্বারা নিজ ক্ষমতা চারণ দ্বারা যে সমস্ত সৎ অসৎ কর্ম্ম সমাধা করে তাহার দ্বারা কর্ত্তৃত্বাভিমানী হইয়া কর্ম্মপাশে বন্দী হয়, কর্ম্মমুক্ত হয় না। অতএব, এটি করিব, এটি করিব না, করিয়া যে সকল কর্ম্মে নিযুক্ত হইবে, তাহা সফল হয় না। প্রারব্ধে যে আছে তাহার ভোগ সেই ইন্দ্রিয়গণকে দিয়া, লক্ষ্য সহিষ্ণুতার দিকে রাখিয়া গুরুর উপর ন্যস্ত করিয়া নিয়ত প্রাণের নিকট থাকিতে সর্ব্বদা চেষ্টা করিবেন। যখন যে ভোগের বেগ সহ্য না হয়, তাহা করিলেও দোষ থাকে না।
(৫৩) বিবাহ করিলে সংসার বন্ধন হয় না, আসক্তিই বন্ধন করে। ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্রং এই শ্রুতি বাক্য। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবাদি সকলেই বিবাহ সংসার পালন করিয়াছেন।
(৫৪) পিতামাতার তৃপ্তির জন্যই লোক সন্তান প্রয়াসী হয় এবং পিতার ইচ্ছা পূর্ণ করাই সন্তানের ধর্ম্ম।
(৫৫) কর্ত্তা কর্ম্ম হইতে লাভ লোকসান দ্বারা ব্যতিব্যস্ত হয়, অকর্ত্তার কোন অভাবই থাকে না।
(৫৬) সংসারের সারই ভগবান, জীব ভাবের এই শক্তি।
(৫৭) পতিব্রতা ধর্ম্ম
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনা পর্য্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম॥
এই যে ভাব ইহা ছাড়া আর কিছুই চায় না, জানে না, অন্য কিছুর দরকার নাই। মহা ঐশ্বর্য্য প্রলোভনের আবাহনকেও তুচ্ছ করে। তাহাকেই পতিব্রতা ধর্ম্ম বলে। গুরু ধ্যানং তথা নিত্যং দেহী ব্রহ্মময়ো ভবেৎ ইত্যাদি। গুরু ব্রহ্মা গুরুঃ বিষ্ণু গুরুর্দ্দেব গুরুর্গতিঃ, গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ ইত্যাদিতে পতিব্রতা জাগাইয়া রাখিয়াছে। অর্থাৎ অদ্বৈত ভাব হৃদয়ে রাখা।
(৫৮) সংসার মায়াময়। যত রকমই চঞ্চল হউক না কেন ততই আনন্দবান আনন্দবর্ষন করিয়া থাকেন।
(৫৯) যে পর্য্যন্ত দেহ থাকে সেই পর্য্যন্ত কষ্ট নিবারণের জন্যই চেষ্টা করা জীবের ধর্ম্ম। প্রত্যেক শরীরের মধ্যে ভগবান সুখময় বিরাজ করেন, ভ্রান্তিবশতঃই কর্ত্তৃত্বাভিমানী সূত্রে নানা রকম দেখিতে পায়। অতএব যাহাতে অন্তকাল পর্য্যন্ত কষ্ট না পায় তাহারই চেষ্টা যথাসাধ্য করিতে হয়।
(৬০) সংসার মায়াময় ভ্রান্তিমুগ্ধ অস্বাভাবিক গতি। ইহাদের হাত চালন হইতে নিষ্কৃতির একমাত্র পতিব্রতা ভগবৎসেবা ভিন্ন অন্য কিছুই নাই। অতএব সর্ব্বদা পতিসেবারয় নিযুক্ত থাকিতে চেষ্টা করিবেন। অচিরে ভগবান কৃপা করিয়া সকল অশান্তি ভ্রান্তি বিবিধ অভাব নাশ করিয়া নিত্যানন্দ আবরণ করিবেন।
(৬১) সংসার মায়াময়, ভাগ্যবশতঃ জীবের গতাগতি কর্ম্ম অকর্ম্ম, লাভ হইয়া সুখী দুঃখী হইয়া থাকে। ভগবানের নিত্য সেবার বাসনার আশ্রয়ে জীব ভাবের নিত্যতৃপ্ততা হেতু জন্ম কর্ম্ম সমাপ্ত হইয়া নিত্যমুক্তির আশ্রয় পায়। গুণাদি তারতম্যতা হেতু অভিমানী বশতঃ কর্ম্মানুগামী হয়। অহঙ্কারাদি সূত্রে পতন হইয়া পরাত্মিকা বুদ্ধির মলিনত্ব হয়, তাহা নিবারণের জন্য ভগবানের স্থল হইতে কর্ম্ম লইয়া কর্ম্ম তদুদ্দেশে সমাপ্ত করিতে চেষ্টা করাই জীবের কর্তব্য কর্ম্ম।
(৬২) সম্বন্ধ, বৈধেয় প্রয়োজন। সম্বন্ধ করিলে বিয়োগ ঘটে না। কর্ত্তৃত্বাভিমানীর কর্ম্ম চেষ্টার দ্বারা শক্তিহীন(জরা) সম্বন্ধ ঘটিয়া ক্ষরত্ব ফল ভোগ করিয়া থাকে। গতাগতি কামকাম্য লাভ মাত্র প্রাপ্ত হয়। অদ্বৈত চেতা হইয়া অকর্ত্তাবুদ্ধির দাসত্ব পরমানন্দ প্রসব করিয়া থাকে। ভগবৎ কৃপা ব্যতীত কিছুই হইতে পারে না। অতএব সর্ব্বদা ভগবৎ কৃপার প্রতিক্ষায় অবহিত হইয়া ভগবৎ কুল স্বভাব মাতৃপদ আশ্রয় করিয়া থাকিতে হয়, ইহাই স্বধর্ম। মাতা স্বভাব, পিতা ধর্ম্ম এই দুই মিলনকে স্বধর্ম্ম বলে। এই অবস্থায় থাকিলে আনন্দের আনন্দ উৎপন্ন হয়। ইহাই নন্দের নন্দন লাভ করা। ব্রহ্ম, আত্মা, ভগবান উপাধি হয়। অতএব সর্ব্বদা সৎসঙ্গ করিতে করিতে নিত্যানন্দ স্বরূপ ভগবৎ পদ লাভ করিতে পারিবেন। অহংকার চিন্তা করিবেন না, বাসনাই বন্ধনের কারণ।
(৬৩) পুরুষকারটি পরমশক্তি, তাহাকে অজ্ঞনান্ধ জীব নানাবিধ উপচারে বিভক্ত করিয়া অভাবগ্রস্থ হইয়া পড়ে। তদ্বারা জন্ম মৃত্যু সুখ দুঃখের ফলপ্রাপ্ত লোভের বন্ধন হইতে উদ্ধার পাইতে পারে না বলিয়াই পুনঃ পুনঃ জরা ব্যাধি জন্ম মৃত্যুর কবলে পতিত হয়। সুখের পিপাসায় ষড়রসে মুগ্ধ হইয়া পড়ে, শান্তির জন্য লালায়িত হইয়া কর্তব্য পথ পতিব্রত পতির আশ্রয়চ্যুত হইয়া অভাবগ্রস্থ হয়। অতএব সর্ব্বধর্ম্ম পরিহারের দ্বারা পতিস্বরূপ সদাচারী অনন্য ভক্তির শরণাপন্ন হইবেন।
(৬৪) মনের স্থির করিবার বিশেষ কোন প্রয়োজন নাই। মনের স্বভাবই স্থির, কর্ত্তৃত্বাভিমান সূত্রে চঞ্চল বাসনায় আলোড়িত হইয়া নানান উপসর্গ এ বন্টন করিয়া দেয়, তাতেই লোক বিমুগ্ধ হইয়া সুখ লাভের প্রত্যাশায় নানাবিধ চেষ্টা করে বলিয়াই আরো চঞ্চল ও উপদ্রব সংযোগ হয়। পতিব্রতা ধর্ম্মকে আশ্রয় করিয়া শরণে নিমগ্ন থাকিতে অভ্যাস করিতে করিতে এবং পতি প্রতি রসের নিমিত্ত স্বীয় কর্ম্মজনিত অপরাধ ক্ষমা প্রার্থনা করিতে করিতে চঞ্চল কার্য্য যে সকল প্রকৃতির সঙ্গ হয় সেই প্রকৃতির ভাবের নিকট হইতে দূরে থাকিবার চেষ্টা করিতে করিতে চিত্ত সঙ্কোচ হয়, পরে মন স্বস্থানে প্রতিষ্ঠা হইয়া থাকে। তাহাতে সুযোগ সুখ অপেক্ষা বেশী সুখ হয়।
(৬৫) সংসারের পথ বহুবিধ রকমে মুক্তির কারণ হয়। তন্মধ্যে দুইটি প্রধান, যাহা দ্বারা উদ্ধার হয়। সকলই অনন্য চিন্তার দ্বারা পরিপুষ্ট হইয়া থাকে। প্রথমটি অকর্ত্তা হইয়া চিন্তা ভাবনা বর্জ্জনে যখন যে অবস্থা উপস্থিত তাহার বেগ সহ্য করা। দ্বিতীয়টি সর্ব্বদা ভগবানকে সখ্য, দাস্য বাৎসল্য কি মধুর ভাবের যে কোন ভাবের একটিতে মুগ্ধ হইয়া তাহাকে পাবার ঐকান্তিক বাসনায় দিবানিশি সর্ব্বত্রে সকল অবস্থায়ই পাবার লালসা করিয়া থাকিতে হয়। সকল দেবতা প্রভৃতি জীবগণের নিকট অপরাধ ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া ভগবৎ কৃপা ভিক্ষা করিতে হয়। এই দুইটি পথই উদ্ধার করিয়া ভগবৎ সাক্ষাৎ প্রাপ্ত হয়। জন্ম মৃত্যু যায়।
(৬৬) ধীর সমীরে যমুনা তীরে বসতি সতত বনমালী।
ধীরভাবে নাম পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ করিতে করিতে ক্রমশঃ বায়ুর স্থিরবর্ত্তী উপস্থিত হয়। তৎপর প্রকাশ পায়, পরে জীতেন্দ্রিয় হয়। ইন্দ্রিয়গণ যে দিকে মনকে কর্ষণ করে সেই দিক হইতে অন্তরালে থাকিবার সতত চেষ্টা করিয়া পুনঃ পুনঃ মনকে ধীর সমীরে রাখার চেষ্টা করিতে হয়। যতই মন চঞ্চল হউক না কেন ততই মনকে ধীর স্থানে রাখিবার চেষ্টা করাই প্রয়োজন। যে সকল বিষয়ে ইন্দ্রিয়গণ প্রলুব্ধ হয় তাহাতে যতই মন আকৃষ্ট হউক না কেন ততই আস্তে আস্তে ধীরের যোগে বশ রাখিবার চেষ্টা করিতে হয়। নির্জ্জন স্থানে বসিয়া ঐ যোগ না করিলে কার্য্য সিদ্ধি হয় না। আর বেশী বাজে আলাপ ব্যবহার করিলেও বাধক অনেক উৎপন্ন হইয়া থাকে। যে পর্য্যন্ত নিদ্রা আকৃষ্ট না হয়, সেই পর্য্যন্ত ধীর সমীরে থাকিতে পুনঃ পুনঃ চেষ্টা করিবেন। কূটস্থ চৈতন্যের আবির্ভাবে নিত্যানন্দের যোগ হয়। ধীর সমীরে যাওয়ার ব্যবস্থাটুকুকে অদ্বৈতভাব বলিয়া থাকে। এখানে প্রতিষ্ঠা রুচি জন্মিলে যে ভাব হয় তাহাকে গদাধর বলে। সতত এই স্থানে আবেগবৃত্তি বর্দ্ধন শক্তিকে শ্রীবাস বলে। এই স্থান ছাড়িয়া অন্য কোন স্থানে মনের গতি এবং কোন কামনা বাসনা না আসে তাহাকে যোগস্থ বলে। এই পরিচর্য্যার প্রতি যে পিপাসা এবং পাওয়ার জন্য যে ব্যগ্রতা অধিক হয় তাহাকে বৈষ্ণব বলে। সতত ইহারই পরিচর্য্যাকারী চিত্তকে ভক্ত বলিয়া জানিবেন।
কোন মন্তব্য নেই: